আমরা কেন হানাফি মাযহাব অনুসরণ করি? অন্ধভক্তি নাকি সুন্নাহর অনুসরণ?
আমাদের ফিরে যাওয়ার গন্তব্য
আমাদের সমাজে প্রায়ই একটা প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসে—আমরা কেন মাযহাব মানি? বিশেষ করে আমরা যারা হানাফি মাযহাবের অনুসরণ করি, আমাদের কি অন্ধভাবে একজন ব্যক্তির রায়কে মেনে নিচ্ছি? নাকি এর পেছনে গভীর কোনো যুক্তি ও দলিল আছে?
আজকের এই লেখায় আমি আপনাদের সামনে একটি মৌলিক সত্য পরিষ্কার করতে চাই। আমাদের গন্তব্য কোথায়? আমাদের গন্তব্য হলো সেই ‘আসলি দ্বীন’—যা রাসূলুল্লাহ (সালালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিয়ে এসেছেন এবং যা সাহাবায়ে কেরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম) নিজেদের জীবনে বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে গেছেন। আমরা সেই যুগেই ফিরে যেতে চাই, সেই আমলগুলোই আঁকড়ে ধরতে চাই। আর হানাফি মাযহাব বা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর ফিকহ হলো সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বাহন।
১. শরীয়তের মাপকাঠি: ইমামের ব্যক্তিগত মত নয়
অনেকে মনে করেন, ফিকহী মাসআলাগুলো বুঝি ইমামদের নিজেদের বানানো বুদ্ধি বা যুক্তি। যেমন, ওযুর সময় কতটুকু ধুবো, মাসেহ কতটুকু করবো, কোনটা ফরজ আর কোনটা ওয়াজিব—এগুলো কি ইমাম আবু হানিফা (রহ.) নিজের মনগড়া ঠিক করেছেন?
উত্তর হলো—না, মোটেও না। ইমাম আবু হানিফা (রহ.) শরীয়তের কোনো ‘কম-বেশি’ বা কোনো ‘মাত্রা’ (Limit/Quantity) নিজে নিজে ঠিক করেননি। তিনি যা কিছু নির্ধারণ করেছেন, তার পেছনে তিনি দুটি শক্ত মাপকাঠি ব্যবহার করেছেন:
১. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস: অর্থাৎ নবীজি কী বলেছেন বা করেছেন।
২. সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর আমল: অর্থাৎ নবীজির ছাত্ররা বা সাহাবীরা সেই নির্দেশকে কীভাবে পালন করেছেন।
বলা যায়, তিনি ছিলেন একজন জহুরির মতো, যিনি প্রতিটি আমলকে হাদিস ও সাহাবাদের আমলের কষ্টিপাথরে যাচাই করে আমাদের সামনে পেশ করেছেন।
২. সাহাবাদের আমল কেন গুরুত্বপূর্ণ?
আমি সব সময় একটা কথা বলি—প্রত্যেকটা কাজ সাহাবাদের আমলের সাথে এবং রাসূলের হাদিসের সাথে মিলাতে হবে। যদি মিলে যায়, তাহলে সেটা ‘সহীহ’ (সঠিক)। আর যদি না মিলে, তবে বুঝতে হবে সেখানে কোনো গড়বড় আছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, হাদিস তো বুঝলাম, কিন্তু সাহাবাদের আমল কেন? কারণ, সাহাবায়ে কেরাম সরাসরি ওহী নাজিল হতে দেখেছেন। রাসূল (সা.) একটি কথা কোন প্রেক্ষাপটে বলেছেন, বা কোনো হুকুমের আসল উদ্দেশ্য কী—তা সাহাবীদের চেয়ে ভালো কেউ বুঝতেন না। তাই ইমাম আবু হানিফা (রহ.) যখন কোনো মাসআলা দিয়েছেন, তিনি কেবল হাদিসের শব্দ দেখেননি, তিনি দেখেছেন সেই হাদিসের ওপর সাহাবীরা কীভাবে আমল করেছেন।
৩. একটি তাত্ত্বিক উদাহরণ: ওযুতে পায়ের গোড়ালি ধোয়া
বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য ওযুর একটি মাসআলা নিয়ে আলোচনা করা যাক। এটি বুঝতে পারলে আপনারা হানাফি ফিকহের গভীরতা বুঝতে পারবেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ওযুর হুকুম দিতে গিয়ে বলেছেন:
“ওয়ামা-সাহু বি-রুউসিকুম ওয়া আরজুলাকুম ইলাল কা‘বাইন”
(তোমরা তোমাদের মাথা মাসেহ করো এবং পা ধৌত করো টাখনু বা গোড়ালি পর্যন্ত)।
এখানে আরবি শব্দ ‘ইলা’ (إِلَى) ব্যবহার করা হয়েছে, যার শাব্দিক অর্থ হলো ‘পর্যন্ত’ (Until/To)। এখন ব্যাকরণগতভাবে বা সাধারণ যুক্তিতে ‘পর্যন্ত’ বললে সীমানাটা বাদও পড়ে যেতে পারে। যেমন, আমি যদি বলি "ঢাকা পর্যন্ত যাও"—তার মানে ঢাকার বর্ডারে গিয়ে থামলেও চলবে।
কিন্তু ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এবং হানাফি ফিকহ এখানে সিদ্ধান্ত দিয়েছে যে, পায়ের টাখনু বা গোড়ালি সহ ধুতে হবে। এখানে ‘ইলা’ (পর্যন্ত) শব্দের অর্থ নেওয়া হয়েছে ‘মা‘আ’ (مع) বা ‘সহ’ (With) অর্থে।
কেন এই অর্থ নেওয়া হলো?
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এখানে ডিকশনারি বা নিজের যুক্তি খাটাননি। তিনি দেখেছেন আমল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন ওযু করেছেন, তিনি কি গোড়ালি বাদ দিয়ে ধুয়েছেন? না।
সাহাবায়ে কেরাম যখন ওযু করেছেন, তারা কি গোড়ালি পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছেন? না। বরং হাদিসে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) পায়ের গোড়ালি বা টাখনু সহ ভালোভাবে ধৌত করেছেন। এমনকি তিনি সতর্ক করে বলেছেন, "ওই গোড়ালিগুলোর জন্য জাহান্নামের আগুন, যেগুলো শুকনো থাকে।"
সুতরাং, ইমাম আবু হানিফা (রহ.) কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন রাসূলের (সা.) প্র্যাকটিক্যাল আমল দিয়ে। তিনি দেখিয়েছেন যে, এখানে আল্লাহর উদ্দেশ্য ‘পর্যন্ত’ বলে সীমা নির্ধারণ করা নয়, বরং ওই অংশটিকে অন্তর্ভুক্ত করা। এটাই হলো হানাফি মাযহাবের সৌন্দর্য—যেখানে শাব্দিক অর্থের চেয়ে সুন্নাহর আমলকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
৪. ওযুর মর্যাদা ও আমাদের অবহেলা
এই যে আমরা ওযুর নিয়ম-কানুন নিয়ে এত খুঁটিনাটি আলোচনা করছি, এর কারণ কী? কারণ ওযু হলো নামাযের চাবি। রাসূলুল্লাহ (সা.) পরিষ্কার বলেছেন:
“লা ইয়াকবালুল্লাহু সালাতা আহাদিকুম...”
অর্থাৎ, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের কারো নামায কবুল করবেন না যখন তার ওযু ভেঙে যায়, যতক্ষণ না সে পুনরায় ওযু করে।
ওযু কেবল হাত-মুখ ধোয়ার নাম নয়। শাব্দিক অর্থে ওযু মানে ‘হুসন’ (সৌন্দর্য) এবং ‘নাজাফাহ’ (পরিচ্ছন্নতা)। আর শরীয়তের পরিভাষায় এটি হলো ‘তহারাতুন মায়িয়াতুন’—পানি দ্বারা অর্জিত এমন এক পবিত্রতা যা আমাদের আখেরাতে মর্যাদাবান করে।
যে ব্যক্তি নিয়মিত ওযুর ওপর অটল থাকে (মুওয়াজাবাত), কেয়ামতের দিন তার জন্য অপেক্ষা করছে তিনটি পুরস্কার:
১. অজস্র সওয়াব।
২. আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রতিদান।
৩. জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা বা দারাজাত।
আমরা কেন ইমাম আবু হানিফাকে মানি?
পরিশেষে, মূল কথায় ফিরে আসি। আমরা ইমাম আবু হানিফাকে (রহ.) অন্ধভক্তি বা আবেগের বশবর্তী হয়ে মানি না। আমরা তাকে এই জন্যই অনুসরণ করি কারণ—তার দেখানো পদ্ধতিটি আমাদের সবচেয়ে নিখুঁতভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলের সাথে যুক্ত করে দেয়।
তার ফিকহ বা মাসআলাগুলো হলো সেই ফিল্টার করা পানি, যা সরাসরি নবুওয়তের ঝর্ণাধারা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তাই হানাফি মাযহাব অনুসরণ করা মানে কোনো ব্যক্তিকে পূজা করা নয়, বরং সুশৃঙ্খলভাবে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ করা।
আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং দ্বীনের সঠিক রাস্তায় অবিচল রাখুন। আমীন।